বাংলাদেশী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ এবং এর ২৩ নাবিক জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হতে পারলেও শিপিং সেক্টরে এখনো রয়েছে জলদস্যু আতঙ্ক। বিশেষভাবে আন্তর্জাতিক জাহাজের গুরুত্বপূর্ণ রুট ভারত মহাসাগর ও এডেন উপসাগরে সাম্প্রতিক সময়ে বেড়েছে সোমালিয় জলদস্যুদের অপতৎপরতা। এই কারণে সোমালিয়ার কাছাকাছি বিস্তীর্ণ সমুদ্রের প্রায় এক হাজার নটিক্যাল মাইল এলাকাজুড়ে হুমকির মুখে পড়েছে বৈশ্বিক জাহাজ। ঝুঁকির দিক চিন্তা করে বাংলাদেশী জাহাজসমূহে আর্মড গার্ডসহ পর্যাপ্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে।
মঙ্গলবার চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে এমভি আবদুল্লাহর মুক্ত নাবিকদের বরণ অনুষ্ঠানে ডিজিটালি যুক্ত হয়ে বক্তব্য দেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। তখন তিনি বলেন, “ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের ঘটনা (জাহাজ জিম্মি) না ঘটে সেজন্য আমাদের সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। যেসব জায়গা ঝুঁকিপূর্ণ, সেখানে আর্মড গার্ডসহ যেন জাহাজ যায়, সেদিকে দৃষ্টিপাত করতে হবে”।
সাগরে জাহাজ চলাচলে নিরাপত্তা প্রদানকারী ইইউ নেভাল ফোর্সের অপারেশন আটলান্টা’ও সোমালিয়াসংলগ্ন এলাকা দিয়ে যাতায়াতের সময় বাণিজ্যিক জাহাজগুলোতে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। জলদস্যুদের হাত থেকে মুক্ত এমভি আবদুল্লাহ চট্টগ্রামভিত্তিক কেএসআরএমের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এসআর শিপিংয়ের মালিকানাধীন। তাদের ২৪টি সমুদ্রগামী জাহাজ আছে।
আবদুল্লাহ জলদস্যুদের কবলে পড়ার পর প্রতিষ্ঠানটি তাদের জাহাজগুলোতে সংযোজন করেছে গার্ডিয়ান নামের অত্যাধুনিক স্ক্যানিং সিস্টেম। এর আওতায় যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় কেএসআরএমের জাহাজগুলোকে মনিটরিং করবে। তারা জাহাজের অবস্থান স্ক্যান করে এর আশপাশে কোনো সন্দেহজনক নেৌযান আছে কিনা তা জানিয়ে দেবে। ফলে ক্যাপ্টেন সতর্ক হওয়ার সুযোগ পাবেন। আন্তর্জাতিক নেৌবাহিনীর সহযোগিতা নেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময়ও মিলবে।
শিপিং-সংশি্লষ্ট সূত্র জানায়, “একদিকে আরব সাগরে কয়েকটি দেশের জাহাজ লক্ষ্য করে হামলা চালাচ্ছে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা। অপরদিকে ভারত মহাসাগর ও এডেন উপসাগরে সোমালি জলদস্যুরা ফের সক্রিয় হয়ে উঠায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচলে দেখা দিয়েছে অস্থিরতা। এর ঢেউ লেগেছে বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজগুলোতেও। বর্তমানে সমুদ্রপথে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন রুটে বাংলাদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন পণ্যবাহী ৯৯টি জাহাজ চলাচল করছে”।
বেশ কয়েক বছর চুপ থাকার পর গত বছরের নভেম্বর থেকে ফের সক্রিয় হয়ে ওঠে সোমালি জলদসু্যরা। তারা ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে একের পর এক বাণিজ্যিক জাহাজে আক্রমণ চালাচ্ছে। সর্বশেষ ১০ মে সোমালিয়ার বোসাসো থেকে ১০০ নটিক্যাল মাইল দূরে মার্শাল আইল্যান্ডের পতাকাবাহী বাণিজ্যিক জাহাজ ক্রিস্টাল আর্কটিকে হামলা করে জলদসু্যরা। জাহাজটির প্রাইভেট সিকিউরিটি ও জলদস্যুদের মধ্যে এ সময় গুলিবিনিময় হয়।
ওই সময় খবর পেয়ে আক্রান্ত জাহাজের কাছাকাছি থাকা ইইউ নেভাল ফোর্সের অপারেশন আটলান্টার একটি যুদ্ধজাহাজ এসে একটি নৌযানসহ ৬ সন্দেহভাজন জলদস্যুকে আটক করে। আটলান্টা অপারেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২৪ নভেম্বর থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত প্রায় ৬ মাসে সোমালি উপকূলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৩৩টি জাহাজে হামলা অথবা হামলার চষ্টো করে জলদসু্যরা। এর মধ্যে কয়েকটি জাহাজ তারা ছিনতাই করতে সক্ষম হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহও রয়েছে। জাহাজটি ১২ মার্চ জিম্মি করেছিল সোমালি জলদস্যুরা ।
৩৩ দিনের মধ্যে মালিকপক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পর জাহাজ ও এর ২৩ নাবিককে মুক্তি দেওয়া হয়। সোমবার মুক্ত এমভি আবদুল্লাহ বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছে। নাবিকরা চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে পৌঁছেছে পরদিন। দস্যুতা বৃদ্ধি পাওয়ায় আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচল চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বলে মনে করছেন শিপিং-সংশি্লষ্টরা।
নিরাপত্তা সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে এসআর শিপিংয়ের সিইও মেহেরুল করিম বলেন, “জাহাজে যেসব নিরাপত্তা নেওয়া হয়, তা কিন্তু কোনো প্রতিরোধ বা প্রতিহত করার ব্যবস্থা নয়। এটা হলো সময়ক্ষেপণ করার একটা বন্দোবস্ত। অর্থাৎ আমি জলদস্যুদের বন্দুকের বিরুদ্ধে পানি ছিটিয়ে তাদের প্রতিহত করব, এটা সম্ভব নয়। পানি মেরে তাদের একটু ডিস্টার্ব করব যেন হাতে কিছুটা সময় পাই। যে সময়ের মাঝখানে নেৌবাহিনী এসে আমাদের সাহায্য করতে পারে”।
তিনি বলেন, “আমরা আন্তর্জাতিক মান অনুসারে জাহাজে যেসকল নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার তার সবকিছু করেছি এবং করছি। নতুন করে একটা পদক্ষেপ নিয়েছি। ভারত মহাসাগর দিয়ে চলাচলকারী জাহাজগুলোর জন্য স্ক্যানিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে”।